নিজস্ব প্রতিবেদক | শুক্রবার, ০১ নভেম্বর ২০২৪ | প্রিন্ট
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া উপজেলার মোগড়া ইউনিয়নের ছয়গড়িয়া শাহআলম উচ্চ বিদ্যালয়ের দীর্ঘদিন ধরে প্রকাশ্যে চলছে প্রধান শিক্ষক ও ম্যানেজিং কমিটির বিরোধ। চলছে প্রধান শিক্ষক কর্তৃক ম্যানেজিং কমিটি ও সাধারণ শিক্ষকের বিরুদ্ধে মামলা। পাশাপাশি শিক্ষার্থীরাও ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষককে করেন অবরুদ্ধ। এ অবস্থার ফলে ব্যাহত হচ্ছে বিদ্যালয়ের স্বাভাবিক শিক্ষা কার্যক্রম।
শিক্ষক ও ম্যানেজিং কমিটির সদস্যদের নামে মামলা করা ওই শিক্ষক হলেন- ছয়গড়িয়া শাহআলম উচ্চ বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক মোছা. সেলিনা বেগম।
শিক্ষার মান উন্নয়নে এবং অবকাঠামো নিয়ে শিক্ষক ও ম্যানেজিং কমিটি যেখানে একত্রিত হয়ে কাজ করার কথা থাকলেও এই বিদ্যালয়টি চলছে তার উল্টো পথে। শিক্ষক নিয়োগকে কেন্দ্র করে দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে বিদ্যালয়টি। বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক সেলিনা বেগম নিজ ক্ষমতাবলে এ কাজ করছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। সেইসঙ্গে তার বিরুদ্ধে স্বেচ্ছাচারিতা, অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ এনে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছ অভিযোগ দেওয়া হয়েছে। অভিভাবকরা বলছেন, এ অবস্থার ফলে বিদ্যালয়ের স্বাভাবিক কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে।
বিদ্যালয় ও এলাকাবাসী সূত্রে জানা গেছে, দীর্ঘদিন ধরে বিদালয়ের প্রধান শিক্ষকসহ ৪টি পদশূন্য রয়েছে। এতে বিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ও শিক্ষা কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। প্রধান শিক্ষক পদে দুই বার নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দিয়েও ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক সেলিনা বেগম নিজের পদ ধরে রাখার জন্য নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করছে না। অন্যান্য পদেও নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে না। ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক কৌশলে নিয়োগ কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত করছেন। তাছাড়া তিনি কমিটির কাছে বিদ্যালয়ের আয়-ব্যয়ের হিসাব দিচ্ছেন না। কমিটির কোনো সদস্যের কথার গুরুত্ব দিচ্ছেন না।
সম্প্রতি তিনি বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সিদ্ধান্ত ছাড়া কমিটির সাবেক সভাপতি ও ভূমিদাতা আবুল বাশার মোবারকসহ কয়েকজনের বিরুদ্ধে আদালতে একটি মামলা করেন। এছাড়া তিনি বর্তমান কমিটির সভাপতি মোহাম্মদ আলী চৌধুরীসহ কমিটির ৩ সদস্যের নামে থানায় মিথ্যা অভিযোগ দেন।
সাবেক সভাপতি ও ভূমিদাতা আবুল বাশার মোবারক হোসেনকে মামলা দেওয়ায় গত ১০ জুলাই হঠাৎ তিনি স্ট্রোক করে মারা যান বলে অভিযোগে আছে। এ জন্য স্থানীয় লোকজন ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষককে দায়ী করেন। তাছাড়া কয়েকদিন আগে ওই শিক্ষক আবারো এই বিদ্যালয়ের ৩ শিক্ষককের বিরোদ্ধে থানায় অভিযোগ দেন। এতে ক্ষোভে ফেটে পড়েন শিক্ষক-শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও গ্রামবাসী।
সর্বশেষ গত বুধবার (৩০ অক্টোবর) সাবেক ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক সেলিনা বেগমকে স্থায়ী বরখাস্তসহ ৪ দফা দাবিতে মানববন্ধন করেন শিক্ষার্থীরা।
মানববন্ধনে শিক্ষার্থীরা অভিযোগ করে বলেন, ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক একজন মামলাবাজ। তিনি বিদ্যালয়ের ভূমি দাতা ও সাবেক সভাপতি আবুল বাশার ওরফে মোবারক হোসেনসহ বিদ্যালয়ের শিক্ষক ও ম্যানিজিং কমিটির সদস্যদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানি করায় তিনি স্ট্রোক করে মারা যান। বিদ্যলয়ের শিক্ষকসহ কমিটির লোকজনের বিরুদ্ধে একের পর এক মামলা দেওয়ায় বিদ্যালয়ের পাঠদান ব্যাহত হচ্ছে। বিদ্যালয়ের পড়ালেখার সুষ্ঠু পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে সেলিনা বেগমকে স্থায়ী বরখাস্ত করতে হবে। এছাড়া অবিলম্বে নতুন প্রধান শিক্ষক নিয়োগ, শিক্ষক ও কমিটির সদস্যদের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার করতে হবে।
বিদ্যালয়ের ৯ম শ্রেণির ছাত্র ইমতিয়াজ জানায়, সেলিনা ম্যাডাম ইংরেজি শিক্ষক। কিন্তু তিনি কোনো ক্লাস নিতেন না। ছাত্র-ছাত্রীদেরকে অকারণে ধমক দেন ও শিক্ষার্থীসহ অভিভাবকদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেন। শিক্ষার পরিবেশ ও শৃঙ্খলা ফেরাতে দ্রত এই ম্যাডামের অপসারণ চাই।
বিদ্যালয় সূত্রে জানা গেছে, এই বিদ্যালয়ে সাড়ে ৩ শতাধিক শিক্ষার্থী রয়েছে। এর মধ্যে শিক্ষক রয়েছে ১০ জন।
শিক্ষার্থী নার্গিস আক্তার জানায়, সেলিনা ম্যাডাম আমাদের সঙ্গে ভালো আচরণ করেন না। অভিভাবকদের সঙ্গেও খারাপ ব্যবহার করেন। তিনি ঠিকমতো ক্লাস করান না। আমরা তার পদত্যাগ চাই। অবিলম্বে একজন প্রধান শিক্ষক নিয়োগের দাবি জানাচ্ছি।
বিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারিক নজরুল ইসলাম বলেন, সেলিনা বেগম কথায় কথায় মামলা করে দেয়। বিদ্যালয়ের সাবেক সভাপতি মোবারক হোসেনের বিরুদ্ধে মামলা দিয়েছিল। মানসিক চাপে মোবারক হোসেনের মৃত্যু হয়েছে। আমিসহ কয়েকজন শিক্ষক ও ম্যানেজিং কমিটির সদস্যদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দিয়েছে। আমরা মামলা সামলাবো না পাঠদান করাবো।
বিদ্যালয়ের সাবেক সভাপতি নিহত মোবারক হোসেনের মেয়ে রেখা বেগম অভিযোগ করে বলেন, আমার বাবা বিদ্যালয়ের একজন ভূমিদাতা। সেলিনা বেগম আমার বাবার বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানি করেছে। মানসিক চাপে আমার বাবার মৃত্যু হয়েছে। আমি সেলিনা বেগমের বিচার চাই।
অভিভাবক আলমগীর হোসেন বলেন, এটি হচ্ছে আমাদের একমাত্র বিদ্যালয়। বিদ্যালয়ে এখন আর শিক্ষার পরিবেশ নেই বলে চলে। শিক্ষার্থীদের পড়ালেখার চাইতে বিদ্যালয়ের নানা সমস্যার কথা বেশি শুনতে পাই। যেদিন থেকে সেলিনা বেগম দায়িত্ব পেয়েছেন তখন থেকেই বিদ্যালয়ের করুণ অবস্থা শুরু হয়। এ অবস্থা মেনে নেয়া যায় না।
ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক সেলিনা বেগম বলেন, আমি ষড়যন্ত্রের শিকার। এই বিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষক ও ম্যানেজিং কমিটির লোকজন আমার বিরুদ্ধে উঠেপড়ে লেগেছে। আমাকে স্বপদে পুনর্বহালের টিঠি দেওয়া হলে বিদ্যালয়ে আসলে ঝামেলা সৃষ্টি করে।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা জুলফিকার হোসেন বলেন, নানা অনিয়মে বিদ্যালয় ম্যানেজিং কমিটি ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক সেলিনা বেগমকে দায়িত্ব থেকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করে। তারা যেভাবে করেছিলেন তা প্রক্রিয়াগত কিছু ক্রুটি ছিল। তিনি পুনরায় দায়িত্ব পেতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের বরাবরে আবেদন করেন। আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে তদন্ত সাপেক্ষ তাকে স্বপদে তাকে পুনর্বহালের চিঠি দেওয়া হয়।
তিনি আরো বলেন, ম্যানেজিং কমটির লোকজনের বিরুদ্ধে মামলা করা ঠিক হয়নি। আমরা যতটুকু জেনেছি এই শিক্ষককে নিয়ে এলাকায় বেশ সমালোচনা হচ্ছে। বিদ্যালয়টি ধরে রাখতে শিক্ষক শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও গ্রামবাসীর মতামতে যা করা দরকার তা করার চেষ্টা করা হবে।
উল্লেখ, গত ৫ জুলাই বিদ্যালয়ের তৎকালীন ম্যনেজিং কমিটি বিভিন্ন অভিযোগে সেলিনা বেগমকে ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি এবং সহকারী প্রধান শিক্ষকের পদ থেকে সাময়িক বরখাস্ত করে। এরপর থেকে তিনি বিদ্যালয়ে যাওয়া থেকে বিরত রয়েছেন। গত সোমবার (২৮ অক্টোবর) তিনি বিদ্যালয়ে গেলে শিক্ষার্থীরা ক্ষুব্ধ হয়ে তার পদত্যাগ দাবি করে বিক্ষোভ মিছিল করেন।
Posted ১০:২৩ পূর্বাহ্ণ | শুক্রবার, ০১ নভেম্বর ২০২৪
ajkerograbani.com | Salah Uddin